• -
পিডিএফ প্রিন্ট ইমেইল

কলেজের কথা :

নগরকান্দা বর্তমানে সালথা,বোয়ালমারী,কাশিয়ানী ও মুকসুদপুর উপজেলার মিলিত প্রান্তিক এলাকার মানুষ আবহমান কালথেকে শিক্ষা ও উন্নয়ন বঞ্চিত। অবহেলিত জনপদ। মানবজীবনের উন্নয়নের মূল উপাদান শিক্ষা । এলাকার শিক্ষা সম্প্রসরণের জন্য ১৯৬৫ সাল থেকে অক্লান্ত শ্রম দিচ্ছেন দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, শিক্ষা প্রশাসক ,সমাজ সেবক প্রফেসর মিঞা লুৎফার রহমান।



নবকাম পল্লী ডিগ্রি কলেজের ইতিকথা

প্রফেসর মিঞা লুৎফার রহমান

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একদিন আমরা তিন ভাই আমাদের বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। পথে যেতে যেতে কথ প্রসঙ্গে ভাই বললেন- ‘যদি সম্ভব হয় গ্রামে একটা কলেজ কর’। বললাম, কলেজ যদি করতেই হয় তা হলে তোমাকে গ্রামে থাকতে হবে। হিসাব-নিকাশ তোমাকে রাখতে হবে। ভাই বললেন ‘ঠিক আছে কলেজ যদি করিস তা হলে আমি শহর ছেড়ে আসবো’। পরদিনই তিন ভাই ভাগ্নীর শ্বশুর বাড়ি গেলাম। ভাগ্নি জামাতা এস.এম ছিদ্দিকুর রহমান কিছুদিন পর রামদিয়া সরকারি শ্রীকৃষ্ণ কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করবে। সেও কলেজ করার কথা শুনে উৎসাহ দিলো। তাকে বললাম, তোমাকেও যদুনন্দী থাকতে হবে। তারপর থেকেই গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসলো। যাই হোক, নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ১৯৯৪ সালে ‘নবকাম পল্লী ডিগ্রি কলেজ’ স্থাপিত হলো।

গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার পেছনে আমার আরো একটি ঘটনা মনে রেখাপাত করে। ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে স্কুলের কাজে বাড়ি গিয়েছিলাম। একদিন বিকালে বাড়ি থেকে বাজারে আসছিলাম। সাথে অনেক লোক ছিল। পথিমধ্যে আমার এক প্রকৌশলী ভাতিজা ডাবলু বললো, ‘কাকা, স্কুলের চিন্তা বাদ দেন, এবার একটা কলেজ করেন’। কিছুক্ষণ ভাবলাম। তখন আরেকটি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। আমার এক নাতিনকে কলেজ থেকে ফিরতে দেখে বলেছিলাম ‘এই রোদের  মধ্যে ২০ মাইল দুরের বোয়ালমারী কলেজে যাও! কত কষ্ট! সুন্দর মুখখানা তো রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে’! উত্তরে সে বলেছিল, ‘এতই যদি দরদ নানা ভাই, তাহলে বাড়ির কাছে একটি কলেজ করে দিন’। ডাবলুর ও শিউলীর কথা এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে আমার মনে অনুপ্রেরণার আঘাত হানলো। আমি ডাবলুকে বললাম, এই হালট থেকে (আরশাদ মোল্লার বাড়ি থেকে নদীর দিকে ) তোদের ঘাটের রাস্তা পর্যন্ত জমি যদি পাওয়া যায় তাহলে কলেজ করবো। ডাবলু বললো, ‘জমি আপনাকে দেয়া হবে’। আমি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলাম।

ডাবলু আর আমি এক অদ্ভুত প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হলাম। কারণ, ডাবলু যে জমি দিতে চেয়েছে, সে জমি তার নয়, আবার আমারও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার মতো অর্থ নেই। আমরা যদুনন্দী হাটে  গিয়ে থামলাম। হাট তখন খুবই ছোট। হাটের চান্দিনা ঘরের সামনে মাদ্রাসার হাফেজ মোঃ জাহাঙ্গীর আলমকে ডেকে আনা হলো। তাকে বললাম, ‘গ্রামে কলেজ করবো দোয়া করেন’। তিনি বললেন, ‘বলেন কি স্যার’! আমাদের সাথে সাবু মোল্লা ছিল।  সে এক বিঘা জমি কলেজকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলো। পরবর্তীকালে অবশ্য সে জমি দেয়নি। যাই হোক, দোয়া হলো। কলেজ প্রতিষ্ঠার দোয়া আল্লাহ গাফুরুর রাহিম কবুল করলেন।

তখন আমি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। ২৫ নভেন্বর, শুক্রবার, ১৯৯৪, কলেজ স্থাপনের জন্য রূপাপাত হাই স্কুলের মাঠে প্রথম সাধারণ সভার দিন নির্ধারিত হলো। নগরকান্দা (বর্তমানে সালথা) বোয়ালমারী , কাশিয়ানী,মুকসুদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের জনগণকে ডাকা হলো। একই তারিখে সারদা সুন্দরী কলেজের কমার্সের ছাত্রীরা বনভোজনে যাবে। ছাত্রীরা আমাকে ছাড়া পিকনিক-এ যাবে না। আমারও যাওয়া সম্ভব নয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার  সভা ডাকা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রীরা বলে বসলো ‘আপনার যেখানে মিটিং আমরা সেখানেই পিকনিক করবো’। ছাত্রীদের বোঝালাম । তারা শুনলো না। অগত্যা কালীনগর কালী বাড়ি প্রাঙ্গণে পিকনিক স্পট ঠিক করা হলো। সহস্রাইল থেকে কালীনগর কাচা রাস্তা। মাটিও ঠিকমত নেই, সেই রাস্তা দিয়ে বড় ‍দুটো বাস নিয়ে ছাত্রীরা এলো, খুবই আনন্দ করলো। আমার বাড়িতে গেল। বিকাল ৪ টার দিকে ওদের বিদায় দিয়ে হাজির হলাম রূপাপাত স্কুলের মাঠে। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ সাধারণ জনগণ উপস্থিত । কলেজ স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। সিদ্ধান্ত হলো, যদুনন্দী হাটের দক্ষিণ পাশে কলেজ হবে। কিছুদিন পরে কলেজ স্থাপনের ২য় সভা অনুষ্ঠিত হয় যদুনন্দী বাজার সংলগ্ন মাদ্রাসার মাঠে। সেদিন চার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষেরা যদুনন্দী হাটের দক্ষিণ পাশের আরশাদ মোল্লার ঘাটের হালট থেকে পশ্চিম পাড়ার আব্দুর রাজ্জাক মোল্লার ঘাটের হালট পর্যন্ত জমি কলেজের জন্য মালিকদের দান করতে বললেন। জমির মালিকগণ সকলের সামনে জমি দান করার ওয়াদা করেন। সভায় সর্বসম্মতভাবে  কলেজ  প্রতিষ্ঠা ও কলেজের নাম নির্ধারণ করার সকল দায়িত্ব আমাকে প্রদান করা হয়। সে সভার একটি ছোট ঘটনা আজ মনে পড়ছে। মাদ্রাসার মাঠে মিটিং করার সময় চার আনার একটি কয়েন টেবিলের নিচে পাই। কয়েনটি ঘাসের উপর পড়েছিল। কয়েনটির দাবিদার পাওয়া গেলো না। অবশেষে সকলেই বললো, এই চার আনা নিয়েই কলেজ শুরু করেন। সেই চার আনা হাতে নিয়ে বিরাট বোঝা হাসতে হাসতে না বুঝেই মাথায় নিলাম। কলেজের নাম নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। নাম কি দিব? আমার গ্রামের নামে কলেজ দিলে অন্য গ্রামের মানুষ কষ্ট পাবে। হয়তো তারা প্রতিবাদ করবে না। নাম যাই হোক তারা একটি কলেজ চায়। কেউ কেউ আমার নামে কলেজ করার কথা বলেছে। আমি রাজি হইনি। অবশেষে একটি নাম পেয়ে গেলাম। চার উপজেলার আদ্যাক্ষর নিয়ে একটি নাম- নবকাম। মহান আল্লাহ আমার সাহায্যকারী।

ন=নগরকান্দা

ব=বোয়ালমারী                                নবকাম

কা= কাশিয়ানী

ম= মুকসুদপুর

নবকাম একটি শব্দ হয়ে গেল যার অর্থ- নতুন কাজ। এখানে কলেজ স্থাপন একটি নতুন কাজ। অজপাড়াগার মধ্যে কলেজ। তাই পল্লী শব্দটা নিয়ে নিলাম।  এক সপ্তাহ পরে মিটিং হলো। কলেজের নাম ঘোষণার সাথে সাথে চার উপজেলার মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লো। আমি বললাম, আজ থেকে ‘নবকাম পল্লী কলেজ’ যদুনন্দী গ্রাম থেকে আলাদা স্থান, সেটা আপনাদের সকলের গ্রাম। কলেজ প্রতিষ্ঠা হলো। হাতে সময় নেই। ১৯৯৫ সালের জুনের মধ্যে কলেজের ঘর-দরজা তৈরি করে ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষা বর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে হবে। আমাকে প্রতি সপ্তাহে গ্রামে আসতে হয়। পূর্বেই লিখেছি, যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না। অক্লান্ত পরিশ্রম হতে লাগলো। জমির দলিল করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। দুয়েক জন জমি মালিক প্রকাশ্য সভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েও জমি দিতে অনীহা প্রকাশ করতে থাকলো। এক জন তো বেঁকেই বসলো। তাদের জন্য অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছিলো। ইদ্রিস মোল্যা, আয়নাল মোল্যা তাদের বুঝাতে চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া অন্য মালিকদের সাথেও তারা কথা বলেছে, রাজি করিয়েছে। কিছু জমির মালিকের বাড়ি বেতাল গ্রামে। তাদের সাথেও তারা যোগাযোগ করেছে। শেষ পর্যন্ত সকলেই জমি দান করেছেন।

প্রাপ্ত জমি রেজিস্ট্রি করার সিদ্ধান্ত হলো। ফরিদপুর থেকে দলিল লেখক আনলাম। ইদ্রিসের উপর দলিল প্রস্তুত করার দায়িত্ব দিয়ে আমি ফরিদপুর চলে গেলাম। পরদিন সন্ধ্যায় এলাম। ইদ্রিস বললো ‘ভাইজান, দলিল লেখা শেষ হয়েছে। কিছু স্বাক্ষরও নিয়েছি’। কালকের মধ্যে অন্য স্বাক্ষরগুলো নেয়া হবে। পরদিন সকালে ইদ্রিস বললো,‘ভাই আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা স্বাক্ষর করছে না।’ সে দানপত্র দলিল দিবে না। সে দিবে অর্পণনামা এবং সেলামি ৩০ হাজার টাকার স্থলে ৩ লাখ টাকা লিখতে হবে। বিকালে সভা ডাকলাম। আব্দুর রাজ্জাক ভাই তার সিদ্ধান্তে অনড়। রূপাপাতের মোশাররফ ফকির (মাস্টার) বিরক্ত হয়ে বললো ‘আপনাদের জমি লাগবে না। কুনু মিয়াকে (আমার ডাক নাম) আমাদের দিয়ে দিন, আমরা কলেজের জমি ওপাড়ে দেব’। সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হলো। সকলের মন খারাপ। বাড়ি ফিরলাম। দক্ষিণ পাড়ার লোকজন আসলো। তারা বললো, ঢন ঘাটের উত্তর পাশে তারা জমি দিবে। রাতে ভাল ঘুম হলো না। এতো দিনের শ্রম একজনের কারণে বৃথা হয়ে যাবে। পরদিন খুব ভোরে আয়নাল মোল্যা, আবদুস সাত্তার মোল্যা ও ইদ্রিস আসলো। আয়নাল মোল্যা বললো ‘ভাডি (ভাই) ওর কথায় রাগ করে কলেজ ওপাড় নিয়ে যেও না । ৩০ হাজার টাকার কাগজ নষ্ট হয় হোক। তুমি অর্পণনামা করে নাও। তুমি সবই পারবে’। তাদের কথা ফেলতে পারলাম না। কি আর করা ? রাজি হলাম। ফরিদপুর গিয়ে অর্পণনামা দলিল সম্পর্কে জেনে আসলাম। রেজিস্ট্রেশন খরচ দানপত্রের চাইতে কম। কিন্তু আইন হলো, যে কাজের জন্য অর্পণ করা হবে সে কাজ যদি না হয় তা হলে জমিদাতারা জমি ফেরত পাবে। রাজ্জাক ভাইকে এ বুদ্ধি তার এক আত্মীয় দিয়েছে। তার ধারণা ছিলো আমার পক্ষে কলেজ করা সম্ভব হবে না। কারণ আমার টাকা পয়সা নেই। সে ক্ষেত্রে জমি হারাবার কোন ভয় নেই।

অবশেষে একদিন সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবকে গ্রামে আনা হলো। কারণ দাতা অনেক মহিলাও আছে। আমার বাড়িতে দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন হলো। গ্রামের সকলেই স্বাক্ষর করলো। বেতালের তিন জন দাতা সময় মতো আসতে পারেনি। পরে তারা দেড় শত টাকার স্ট্যাম্পের উপর স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। অনেকেই জমি দান করেছেন। তবে খালেক মোল্লা কলেজকে বেশি জমি দিয়েছেন। আল্লাহ তার মঙ্গল করুক। সকল জমিদাতাদের জন্যই আমি দোয়া করি। সকলের বংশেই শিক্ষিত নীতিবান লোক জন্ম নিক। রেজিস্ট্রেশনের টাকা কম হওয়ায় আজাদ কিছু টাকা দিল।

মাননীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে নগরকান্দা ফরিদপুর-২ এর সংসদ সদস্য ছিলেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা তাঁর কাছে ব্যক্ত করায় তিনি আমাকে উৎসাহ দেন এবং সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি থেকে কলেজের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। এবারও তিনি কথা দিয়েছেন যে, কলেজে সম্মান, মাস্টার্স শ্রেণি খোলার জন্য তিনি সহযোগিতা করবেন। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু সুস্বাস্থ্য ও সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ কামনা করি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তিনি একজন বাঙালি, বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আশা করি, তাঁর সুনজরে আমাদের কলেজের অগ্রযাত্রার রথ এগিয়ে চলবে। এলাকার মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গতি সঞ্চার হবে। কলেজের জমাজমি নিয়ে সমস্যার সময় কলেজের মঙ্গলের জন্য তিনি আমাকে সুপরামর্শ দিয়েছেন। আমি তাঁর কাছে ঋনী। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া গেলো। এবার কলেজ প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় পর্যায়। ঘর নির্মাণ, শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগ-অনেক কাজ। কলেজ যেখানে হবে সেখানে অনেক তাল খেজুরের গাছ সেগুলো তুলতে হবে। জঙ্গল পরিস্কার করতে হবে। প্রতিটি কাজেই অর্থের প্রয়োজন। জেলা প্রশাসক জনাব এম. এন. হুদা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব আলী আকবর চৌধুরী অনেকবার আমার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক কষ্ঠ করে কাঁচা রাস্তায় জিপ চালিয়ে কালিনগর বাজার, রূপাপাত স্কুল প্রাঙ্গণ ও যদুনন্দী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে মিটিং করেছেন। মানুষকে কলেজের জন্য সাহায্য করতে বলেছেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জনাব নুরুদ্দিন বিশ্বাসও প্রায় আসতেন। আমার কাছে মনে হয়েছে জেলা প্রশাসক জনাব এম.এন. হুদা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব আলী আকবর চৌধুরী, বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল মতিন সকলেই আমার এলাকার মাটির মানুষ। এঁদের যে শ্রম নবকাম পল্লী কলেজের জন্য তা ভুলবার নয়। তাঁদের আন্তরিকতা লিখে প্রকাশ করার নয়। তাঁরা ছিলেন ঐ এলাকার মানুষের আত্মার আত্মীয়। হঠাৎ করে শুনলাম জেলা প্রশাসক জনাব এম.এন. হুদার বদলির আদেশ এসেছে। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। জেলা প্রশাসকের সাহায্য ব্যতীত কলেজ করা খুবই কষ্টকর। বলা যেতে পারে জেলা প্রশাসকের বদলিতে আমি ভেঙ্গে পড়লাম। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আমাকে সাহস দিলেন। তিনি বললেন, ‘জেলা প্রশাসক হয়ে যিনি আসবেন, তিনিও আপনার কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাতে সাহায্য করেন আমি সে ব্যবস্থা করবো’। কথাও কাজের কোন অমিল হয়নি। ডি.সি হুদা সাহেবকে কলেজ থেকে বিদায় দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। তিনি অনুষ্ঠানে আসলেন। বললেন-

‘নবকামকে কোন দিন ভুলতে পারবো না। কারণ নবকামে আসতে আসতে গাড়ির ঝাকুনিতে কোমরে যে ব্যথা হয়েছে, এ ব্যথা সারবার নয়। যখন ব্যাথা বাড়বে তখনই নবকামের কথা মনে পড়বে। নবকাম আমায় সারা জীবন জ্বালাবে মনে পড়বে, ব্যথায় সৃষ্টির আনন্দ পাব। কিছুই করতে পারিনি। তবু মিঞা লুৎফার রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এই অজপাড়াগায়ে আমার কর্মস্থলের শেষ প্রান্তে আসতে পেরেছি, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছি, এটা আমার বড় পাওয়া। নবকাম পল্লী কলেজ অনেক বড় হবে। ওপাড়ের গ্রোথ সেন্টার নবকাম পল্লী কলেজ, এলাকার উন্নয়ন সবকিছু মিঞা লুৎফার রহমানকে অমর করে রাখবে। আপনারা তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করবেন’। এভাবে ‘ফেয়ার ওয়েল’ বক্তব্য শেষ করলেন।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক হয়ে এলেন জনাব আবদুল হক চৌধুরী। প্রথম পরিচয়েই তিনি অনেক আন্তরিকতা দেখালেন। পরবর্তীকালে কলেজের জন্য তার যে অবদান, সে কথা ভাষায় বর্ণানা করা যায় না। ফান্ড সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে নবকাম পল্লী কলেজ ছিল তার ধ্যানের ছবি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতেন কি করে নবকাম পল্লী কলেজকে সু্প্রতিষ্ঠিত করা যায়। তাঁর সাথে যুক্ত হলেন পুলিশ সুপার জনাব ফজলুর রহমান। জেলা প্রশাসক জনাব আবদুল হক চৌধুরী ও পুলিশ সুপার ফজলুর রহমান বহুবার নবকামে গিয়েছেন।

কলেজ প্রতিষ্ঠায় এলাকাবাসীর ত্যাগ অপরিসীম কেউ জমি দিয়েছেন, কেউ সাধ্যমতো অর্থ সাহায্য করেছেন, কেউ অমূল্য কায়িক শ্রম দিয়েছেন। আমার অনেক ছাত্র অর্থ সহযোগিতা করেছে। আমার ছাত্র প্রকৌশলী শহীদুল হাসান রূপাপাত স্কুল মাঠে অর্থ সংগ্রহ সমাবেশে প্রধান অতিথি থেকে সহযোগিতা করেছে।

বাঁশের খুটির উপর টিনের দোচালা তুলে কলেজ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। কলেজের জন্য নিবেদিত প্রাণ আমার বড় ভাই গ্রাম থেকে বাঁশ, টিন সংগ্রহে নেমে পড়ে। এস এম ছিদ্দিকুর রহমান(ছিদ্দিক) ভাই- এর সাথে কাধে কাঁধ মিলিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দিন-রাত শ্রম দিতে থাকলো। আমি মাঝে মাঝে থেমে গেলে ছিদ্দিক আমাকে সাহস যুগিয়েছে। প্রকৃত অর্থেই ভাই এবং ছিদ্দিক না হলে কলেজ করতে পারতাম না। শুধু জমি আর টাকা হলেই প্রতিষ্ঠান করা যায় না। উদ্যোগ লাগে। উদ্যোগীর উদ্যোগ থেমে গেলে প্রতিষ্ঠান হয় না। অনেক ক্ষেত্রে জীবনবাজী রেখে ছিদ্দিক কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ করেছে।

বাঁশের খুটির দোচালা টিনের ঘরে কলেজ-ভাবতে অস্বস্তি লাগে। কি করি! বাকিতে ইট কেনার উদ্দেশ্য নিয়ে বোয়ালমারী গেলাম। আমার ছাত্র প্রফেসর আঃ রশিদ, প্রফেসর শাহাদতকে নিয়ে ইট ভাটায় গেলাম। ইট আগেই বিক্রি হয়ে যাবার অজুহাত দেখিয়ে তারা বাকিতে ইট দিলেন না। বিফল হয়ে আসলাম। অবশেষে আল্লাহর অশেষ কৃপায় ইটের ব্যবস্থা হয়ে গেল। দুনিয়াতে ভালো মানুষ আছে। একদিন সকালে অফিসে যাব। তখন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেছি। ড্রইং রুমে এসে দেখি দুটো লোক বসে আছে। কুশল বিনিময় হলো। একজন আমার ছাত্র মনোরঞ্জন সাহা। রাজেন্দ্র কলেজের জিএস ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের দ্বারা আহত হয়ে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। অন্যজন ইট ভাটার মালিক প্রকাশচন্দ্র সাহা। আমি যে বোয়ালমারী ইট কিনতে গিয়ে পাইনি এটা শুনে মনোরঞ্জন(মনা) কষ্ট পেয়েছে। মনা ইটভাটার মালিক প্রকাশ সাহাকে নিয়ে এসেছে। প্রকাশ সাহা বাকিতে ইট দেবে। প্রকাশ সাহাকে বললাম প্রাথমিক পর্যায়ে ১ লাখের মত ইট লাগবে। নির্মাণ কাজ শুরু করলে টাকা পাব এবং আপনার ইটের টাকা পরিশোধ করে দিতে পারবো। প্রকাশ চন্দ্র সাহা বললো , ‘স্যার শুধু ট্রাক ভাড়ার ব্যবস্থা করেন ইট আমি দেব। টাকা যখন হয় দেবেন।’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এত টাকার ইট বাকি দিবেন! আমার হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে তো টাকা পাবেন না। প্রকাশ চন্দ্র সাহা বললেন, ….. তারপর কেউ টাকা না দিলে সে সব মাফ করে দেবে। প্রকাশ সাহার বক্তব্য শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। মনা বললো এটাই কথা। প্রকাশ সাহা বললো, ‘ইট কবে থেকে পাঠাবো স্যার?’ কলেজ মাঠে ইট ফেলানো শুরু হলো। সবাই বিস্মিত। ভাই জানতে চাইলেন, ইট কী কাজে এলো। জানালাম, কলেজের ইট, ইটের দেয়াল এবং টিনের চাল হবে। ভাই খুবই খুশী হলেন। ছিদ্দিক মিয়া আনন্দে কাজের গতি দ্বিগুণ বাড়ায়ে দিল।

ইট আসতে থাকলো, বালিও আনা হলো, কিন্তু সিমেন্ট কেনার টাকা নেই। অবশেষে ট্রলার ভরে ছিদ্দিক রামদিয়া সোহরাব শরীফের দোকান থেকে সিমেন্ট বাকিতে নিয়ে আসলো। ঘর দক্ষিণ পূর্বদিক থেকে শুরু করা গেল না। একজন দাতার জমিতে আখ ছিল। সেগুলো বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত কাজ করা যাবে না। আঃ রব (বর্তমান চেয়ারম্যান) ভাই এবং অন্য সকলের সাথে আলোচনা করে দক্ষিণ পশ্চিমের বড় ঘরটির নির্মাণ কাজ শুরু করে দিল। ডিসি এবং এসপি এসে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। প্রথম পশ্চিম পাশের বড় ঘরটি হয়ে গেল। ঘরের টিন গ্রামের মানুষই দিয়েছে, বোয়ালমারীর প্রাক্তন এমপি কাজী সিরাজুল ইসলাম দিয়েছেন, রামদিয়া সোহরাব শরীফের কাছ থেকে বাকিও আনা হয়েছে। এর মধ্যেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এডিসি আলী আকবর চৌধুরী নির্বাহী কমিটির সভাপতি। আমি তখন রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ। আমার ছোট ভাই আতিয়ার রহমান মিয়া(মনু) তখন ফরিদপুর পূবালী ব্যাংকের ম্যানেজার। শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলো। অধ্যক্ষ কোথায় পাবো। রাজেন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান প্রফেসর হরিদাস কুন্ডু সবেমাত্র অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি আমার সাথে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজে এবং দীর্ঘ কাল সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে চাকরি করেছেন। আমি তাঁকে বললাম, দাদা, আপনাকে নবকাম পল্লী কলেজের অধ্যক্ষ হতে হবে। তিনি বললেন, স্যার, আর চাকরি করতে ইচ্ছা করে না। আমি বললাম, এতো চাকরি না, একটি কলেজ স্থাপন করা। আমি ছিদ্দিক এবং মনু এক সাথে বলাতে দাদা প্রফেসর হরিদাস কুন্ডু রাজি হয়ে গেলেন। অবশ্য বউদিকেও অনুরোধ করতে হয়েছে। বউদিও আমার সাথে বঙ্গবন্ধু কলেজ ও সারদা সুন্দরী কলেজে দীর্ঘ দিন লাইব্রেরীয়ানের পদে চাকরি করেছেন। কুন্ডু বাবু চাকরিতে আমার জুনিয়র কিন্তু বয়সে বড় হওয়ায় আমি তাকে দাদা বলতাম। তিনি অফিসিয়াল ভদ্রতায় স্যার বলতেন। আমাদের সম্পর্ক ছিল খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ। দাদা অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ায় ছিদ্দিক ও মনু খুব খুশী হলো। কুন্ডুদা, ছিদ্দিক ও ভাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কলেজের জন্য কাজ করতে থাকলো।

তখনো সহস্রাইল-কালীনগর রাস্তা কাচা। একদিন মিটিং করতে এলেন এডিসি সাহেব। কলেজ প্রাঙ্গণে মিটিং করা হলো। হঠাৎ প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হলো। যতদুর মনে পড়ে তখন ভাদ্র মাস ছিলো। মিটিং শেষ করে এডিসি, দাদা এবং আমি রওয়ানা দিলাম। এডিসি সাহেবের গাড়ি। খরা ঘাটা ব্রিজের উপর গাড়ি উঠানো যাচ্ছে না। আমরা গাড়ি ঠেলতে লাগলাম। আমাদের কষ্ট দেখে অনেকেই সাহায্যে এগিয়ে এলো। গাড়ি ব্রিজের উপর উঠানো হলো। দানেশ ড্রাইভ করে সহস্রাইল পাকা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে এলো। এভাবে আমাকে বাদ দিলেও যারা আমাদের এলাকার নয় তারাও এ কলেজ স্থাপনে কত কষ্ট করেছে। এডিসি আলী আকবর চৌধুরী, কুন্ডুদা, ড্রাইভার দানেশের ঋণ শোধবো কীভাবে? দোয়া করি আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুক। কলেজের ভবন নির্মাণের সাথে চেয়ার, বেঞ্চ, টেবিল, আলমারিও প্রয়োজন। এ-ক্ষেত্রে যাঁর সহযোগিতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তিনি হলেন বোয়ালমারীর ইউএনও আবদুল মতিন। রুপাপাত কাছারির সরকারি গাছ নামমাত্র মূল্যে ক্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। যদুনন্দী, কালিনগর ও রূপাপাতের মানুষ সে সব গাছ কেটে নদীতে ভাসিয়ে কলেজে এনেছে। ভবন ও চেয়ার টেবিল তৈরি হবার পর বড় কাজে লেগে পড়ে ছিদ্দিক মিয়া সেটা হলো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি। ভর্তি অনুমতি আনার জন্য ছিদ্দিক ঢাকা বোর্ডে অনেকবার গিয়েছে। আমিও বার বার ফোন করেছি তৎকালীন চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দীন আহমেদকে। একদিন অনুমতি মিলে গেছে। অবশ্য তার পূর্ব থেকেই ছিদ্দিক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি শুরু করে দিয়েছিলো।

নবকাম পল্লী কলেজের বিশেষ দিন ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসের ৯ তারিখ- সোমবার। সেদিন কলেজের ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয়। তার আগের দিন ৭নং কক্ষে মিলাদ হয় বোয়ালমারী থেকে আমার ছাত্র রশীদ ও অন্যান্যরা এলো। শুরু হয়ে গেল কলেজ। অবশ্য তখনো অনেক কাজ অসমাপ্ত। কলেজ সৃষ্টি লগ্নে প্রথম নিয়োগ প্রাপ্ত ১১ জন শিক্ষকের মধ্যে ৪ জনের বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় আমাকে নিজ তত্ত্বাবধানে ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছে পুরুষ শিক্ষক জামান ও মিজানের থাকার ব্যবস্থা করেছি মাদ্রাসার হুজরা খানায় আর মহিলা শিক্ষক পারভিন ও অঞ্জনাশীলের থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছে আমার নিজ বাড়িতে। ওরা চার জন একত্রে আমার বাড়িতে মেস করে খেত। পরবর্তীতে দূরের ছাত্রীদের থাকার সমস্যা দেখা দেওয়ায় আমার বাড়িতে আরেকটা ঘর ছাত্রী হোস্টেল হিসেবে বরাদ্দ দেই। শিক্ষকদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য ছিদ্দিক মিয়া শিক্ষক ও অধ্যক্ষের বাসভবন তৈরির কথা বললো টাকার সংকট বলে তাকে সাময়িকভাবে বিরত থাকতে বলেছি। কিন্তু ছিদ্দিক শিক্ষক ও অধ্যক্ষের বাসভবনের স্থান মনে মনে নির্ধারণ করে পূর্বেই ভাইয়ের সম্মতি নিয়ে রেখেছে। পরে আমাকে বলেছে। কাজেই ভাইয়ের সম্মতির পর আমি আর না বলতে পারি নি। ছিদ্দিক বাসভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে দিল। অর্থ সংকটের বিষয়টি তাকে বোঝানোই যেতো না। সে আমাকে ‘টাকার গাছ’ মনে করে রেখেছিলো। অবশ্য অর্থ যোগাড় ও সরবরাহ আমাকেই করতে হয়েছে। অবশেষে দুই বছরের মধ্যে ছিদ্দিক আট জন শিক্ষকের ও অধ্যক্ষের বাসভবন নির্মাণ করেই ছাড়লো। এর জন্য প্রয়োজনীয় জমি আমরা তিনভাই কলেজকে দান করলাম। কলেজে মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখা খোলা হলো। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব আলী আকবর চৌধুরী একদিন আমাকে ফোন করে জানালেন যে, কারিগরি বোর্ডের অধীনে ফরিদপুর জেলায় দুটো কলেজে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ( কম্পিউটার অপারেশন ও সেক্রেটারিয়েল প্রাকটিস) খোলা হবে। কারিগরি বোর্ড কলেজের নাম চেয়েছিলো। নবকাম পল্লী কলেজের নাম দেওয়া হয়েছে। এ-যেন না চাইতেই বৃষ্টি। আমি খুশি হয়ে বললাম, আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ থাকলো না। আরেক ভাবনা আমাকে পেয়ে বসলো। গ্রামে ইলেকট্রিসিটি নেই, কম্পিউটার শাখা চলবে কীভাবে। কিন্তু বিষয়টি তখনো প্রকাশ করিনি। কম্পিউটার ও টাইপ মেশিন এসে গেল। ড. আঃ মান্নানকে অনুরোধ করলাম জেনারেটর দান করার জন্য। তিনি জেনারেটর দিয়ে দিলেন। কিন্তু দেখা গেল জেনারেটরে কম্পিউটার ঠিকমত চালানো যায় না। একটি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেল। কারিগরি বোর্ডে চিঠি লেখা হলো। কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আসলেন। বললেন আরো শক্তি সম্পন্ন জেনারেটর লাগবে। তিনি পরামর্শ দিলেন সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। খরচ অনেক। টাকা পাই কোথায়। চিন্তা করতে করতে মনে পড়লো এলজিইডি প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল হাসানের কথা। ওর সাথে দেখা করে সব খুলে বললাম। সব শুনে শহীদুল হাসান বললো, ‘স্যার, দেখি কি করা যায়’ । কিছুদিন পরে রহিম আফরোজ কোম্পানি থেকে কলেজে লোক আসলো। সোলার বিদ্যুত ব্যবস্থা করে দেবার জন্য তাদের এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান পাঠিয়েছে। তারা সার্ভে করে গেল। কিছুদিন পর তারা সোলার বিদ্যুৎ সংযোগের যাবতীয় মালামাল নিয়ে এলো। কলেজে স্থাপিত হলো সোলার সিস্টেম। সোলার বিদ্যুতে কম্পিউটার শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকলো। আবার সমস্যা। সোলার সিস্টেমে কম্পিউটার চলে, কিন্তু প্রিন্টার চলে না। ব্যাপারটি শহীদুল হাসানকে জানালাম। কিছুদিন পর রহিম আফরোজ কোম্পানির লোক এসে আর একটি সোলার প্যানেল বসালো। শক্তি বাড়লো। প্রিন্টার চললো। এভাবে নবকাম পল্লী কলেজে সর্বাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষাক্রম চালু হলো। যার পেছনে অবদান আমার ছাত্র প্রকৌশলী শহীদুল হাসানের।

শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তি এবং কলেজের স্বীকৃতি- এদুটো বড় কাজ ছিদ্দিক অস্থির হয়ে উঠলো। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দিন ভাইকে বললাম। বলতে লজ্জা নেই। একদিন আমি তাঁর নিকট গেলাম। তাঁর রুমে জোহরের নামাজ পড়ার পর তাঁর দুই পা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘বস, আমার কলেজের স্বীকৃতি’। ময়েজ ভাইকে আমি বস বলতাম। তিনিও আমাকে বস বলতেন। সম্পর্ক মধুর। তিনি বললেন, ‘আরে কী করেন! পাগল হলেন নাকি! ফরিদপুর যান ব্যবস্থা হবে।’ কিছুদিন পর কলেজে ইনেসপেক্টর এলো। ইনেসপেকশন হলো। ছিদ্দিক মিয়ার ঢাকায় যাতায়াত বেড়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন, কলেজের স্বীকৃতি এ নিয়ে সে চরম ব্যস্ত।

১৯৯৬ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন ফরিদপুর নতুন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। ছিদ্দিক ঢাকা থেকে কলেজের স্বীকৃতির কপি নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে উপস্থিত হলো। চিঠিটা আমার হাতে দিলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলেও সত্য যে, চিঠিটা পড়ার পর আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।

কলেজ ভবন, আসবাবপত্র, স্বীকৃতি- সব হলো। এবার ছিদ্দিকের টার্গেট শিক্ষক কর্মচারীর এমপিওভুক্তির বিষয়টি। ব্যবস্থা করার জন্য সে প্রতিদিন আমাকে বলে। মফস্বলে একটি কলেজের জন্য এমপিওভুক্তি কতটা প্রয়োজন তা আমি জানতাম। আমিও সেটার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ছিদ্দিকের প্রতিদিনের ফরমায়েশে একদিন বিরক্ত হয়ে বললাম, কলেজ এমপিওভুক্ত হলে তোমার কী? তুমিতো আর এমপিওভুক্ত হবা না। ছিদ্দিক বললো ‘শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্ত না হলে কলেজ চলবে কী করে? তারা বেতন-ভাতা ঠিক মতো না পেলে কলেজে আত্মনিবেদন করবে কীভাবে? আমি তার কথায় মুদ্ধ হলাম। এমপিওভুক্ত না হলে কলেজ ভালভাবে চলবে না- তার ভাবনা আমাকে বিশেষভাবে তাড়িত করলো। সত্য কথা যে, কলেজ কার্যক্রম প্রতিষ্ঠায় অনেকেই ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু ছিদ্দিকের মতো এতোটা কেউ আর করেনি। পরবর্তীকালে আমি ডিসি আবদুল হক চৌধুরীকে কলেজটিকে এমপিওভুক্তির জন্য সুপারিশ করেছি। তিনি ছিলেন এমপিও সুপারিশকারী টিমের প্রধান। তিনি, আমার ছাত্র জয়েন্ট সেক্রেটারি সেকান্দার আলী মন্ডল ও ডেপুটি সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী এমপিওভুক্তির জন্য আমাকে সহযোগিতা করেছে। কলেজের প্রচার কাজে পোস্টার লাগাতে যাকে যাকে দিয়েছি  সকলেই বাড়ি ঘরে লাগায়ে রেখেছে। শাহজাহানকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম দুর দুরান্তে পোস্টার লাগাতে। সে ঠিকই লাগায়েছে। পানির মধ্যে সাৎরায়ে পথ পাড়ি দিয়ে ডাঙ্গায় গিয়ে পোস্টার লাগায়েছে। তারপর পাঠালাম দেখতে যাকে যেখানে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেখানে পোস্টার আছে কিনা। শাহজাহান গিয়ে পোস্টার পায় নাই। আবার লাগিয়েছে। কস্ট যারা করেছে তারা অত ফলাও করে বলে না। পিওনরা সকলেই প্রচুর কাজ করেছে প্রতিষ্ঠালগ্নে। যাকে যে কাজ দেয়া হয়েছে তারা পিছপা হয়নি। খালি কলসীর বাজনা বেশি। কাজ করুক বেশি করুক নাই বা করুক কলেজ প্রতিষ্ঠায় আমি সকলের কাছে ঋণী। কলেজের এম.পি.ও হয়ে গেল। কলেজ ভাল চলছে। গভর্নিং বডি গঠিত হবে। আমি মিটিং ডেকে বললাম আপনারা সিলেকশন বা ইলেকশন করে গভর্নিং বডির সদস্য দিন। সকলের একই কথা ডিগ্রি কলেজ না হওয়া পর্যন্ত আপনার যাকে খুশী তাকে নিয়ে কলেজ গভর্নিং বডি গঠন করেন। আমরা সব সময় আপনার সাথে আছি। আমরা ডিগ্রি কলেজ চাই। আমি অনেক ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু কেউ তা গ্রহন করেন নি। সকলের একই কথা ডিগ্রি কলেজ ডিগ্রি খোলার আগ পর্যন্ত কোন নির্বাচন নেই, আমাদের কোন সিলেকশন নেই। মহা বিপদ। মেম্বার আমাকে ঠিক করতে হবে। প্রথমবারেই আঃ রব মোল্লাকে মেম্বার করাতে রাজ্জাক ভাই মেম্বার হতে রাজি হলো না। যা হোক কাজ থেমে থাকেনি। কলেজের একবারের দক্ষিণ পশ্চিমের ঘরটা করার সময় রাজ্জাক ভাই বাধা দিলেন। আঃ রবের সাথে বাকবিতন্ডা হলো। ঘর বাধা দিতে পারলো না, কিন্তু আঃ রবসহ বেশ অনেককে আসামি করে ফৌজদারী মামলা করে দিল। কয়েক বছর পর্যন্ত আঃ রব কেস চালিয়েছে। সমস্ত খরচ নিজে দিয়েছে। কলেজ থেকে একটি টাকাও নেয়নি। সে কিন্তু বলে না, কলেজ করতে আমার রক্ত পানি করেছি।

কলেজের কার্যক্রম এগিয়ে চলার পথে হঠাৎ ষড়যন্ত্র শুরু হলো। কিছু লোক কলেজ মাঠের পশ্চিম পাশের জমির অর্ধেক বরাবর রাতারাতি দোকান তুলে হাট-বাজার  বসাবার ব্যবস্থা করে ফেলল। সংবাদ পেয়ে বাড়ি আসলাম। যারা দোকান-পাট তুলেছিলো তাদের ডাকলাম। তাদের বললাম, এখানে দোকান-পাট বসলে কলেজে শিক্ষার পরিবেশ থাকবে না। দোকান-পাট সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা পরিবেশ বোঝে না, শিক্ষা বোঝে না। তারা জানালো যে, কলেজের ঘরে লেখাপড়া হবে, পাশের দোকান পাঠে বেচাকেনা হবে, তাতে কলেজের ক্ষতি কী? তারা আমার  কথা শুনলো না। রাতারাতি আরো দোকান-পাট তুলে ফেললো। কী আর করা। কলেজের পরিবেশ রক্ষায় অবশেষে বাধ্য হয়ে প্রশাসনের সাহায্য নিলাম। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জনাব সাখাওয়াত হোসেন এসে সব দেখে-শুনে জেলা প্রশাসকের কাছে রির্পোট দিলেন। জেলা প্রশাসক জমি হুকুম দখল করে কলেজকে দিলেন। আরেক সংকটে পড়লাম। জমি তো কিনতে চাইনি। এবার বাধ্য হয়ে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু টাকা পাব কোথায়! যা হোক, অবশেষে বহু কষ্টে টাকা যোগাড় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিলাম। এ সময় ড. আঃ মান্নান টাকা দান করেছেন। অধ্যক্ষ কুন্ডুদা অনেক টাকা ধার দিয়েছেন। মনু দিয়েছে। আখেরি সম্বল হিসেবে শিল্প ব্যাংকে আমার ত্রিশ হাজার টাকা জমা ছিলো। মনু সে তথ্য জানতো। সেই টাকাটাও সে নিয়ে নিলো। সে সময় আমার ছাত্র রূপাপাত গ্রামের নূর মোহাম্মদ দশ হাজার টাকা দান করে ছিল। সে কলেজ করার সময়ও দশ হাজার টাকা দিয়ে ছিল। এই সময় কদমীর আকরামও টাকা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হলো। প্রশাসন কলেজকে জমি দখল দিয়ে গেল। তারপরও বহু ভোগান্তি। সে জমি নিয়ে মামলাও করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ মোসায়েদ হোসেন ঢালী দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার সাথে সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেছেন।

ব্রিজ নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে এল.জি.ই.ডি প্রধান প্রকৌশলী জনাব শহীদুল হাসানকে একদিন বললাম গ্রোথ সেন্টার , ব্রিজ, কলেজ হয়ে গেল এখন সহস্রাইল কালীনগর রাস্তাটি পাকা করে দাও। শহীদুল হাসান বললো ‘স্যার সহস্রাইল কালীনগর রাস্তায় আপনার কথায় যে চাল/গম মাটির কাজের জন্য দিয়েছি তাতে যদি মাটি না ফেলে চাল/গম ঢেলে দিতাম তা হলেও রাস্তার যে উচ্চতা হবে তা হয়ে যেত, অথচ এখনও মাটির কাজ অনেক বাকি’। আমি অনুরোধ করলাম তাড়াতাড়ি রাস্তাটি পাকাকরে দেয়ার জন্য। সে বললো ‘এ বছরেই মাটির কাজ শেষকরে অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে চার কি.মি. পাকা করে দিব’। আমি বললাম আমি যদি মরে যাই তাহলে তো আর পাকা রাস্তা দিয়ে বাড়ি যেতে পারবো না। উত্তরে শহীদুল হাসান বললো ‘স্যার আপনি যদি মরে যান তা হলেতো রাস্তা করবোই না’। এই ভাবে কথাবার্তা বলে সেদিন আগারগাঁও অফিস থেকে চলে এলাম। কিছুদিন পরে শুনলাম সহস্রাইল কালীনগর রাস্তা ৯ কি.মি. পাকা করার টেন্ডার হয়ে গেছে। ফরিদপুরের কন্ট্রাক্টর আমার ছাত্র খলিফা কামাল টেলিফোনে আমাকে জানালো যে সে ঐ রাস্তার কাজ পেয়েছে এবং শীঘ্রই কাজ শুরু করবে। শুরু করা দিন আমাকে যেতে হবে বললো। রাস্তার কাজ শুরু হলো এবং বছর খানেকের মধ্যে শেষ হলো। প্রথম যে দিন পাকা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঢুকলাম সেদিন সহস্রাইল প্রান্তে নেমে আবেগে রাস্তাকে চুমু দিলাম। শহীদুল হাসান কলেজ কেন্দ্রিক আরো বহু রাস্তা ও ব্রিজ করে দিয়েছে। অবশেষে কলেজের সাথে এলাকার যোগাযোগ সুগম করার চেষ্টা করি। কারণ, কাশিয়ানী ও মুকসুদপুর থেকে কলেজে আসার যোগাযোগ ভাল ছিলো না। রাস্তা দরকার, কুমার নদীর উপর ব্রিজ দরকার। কী করা যায় ! আবার প্রকৌশলী শহীদুল হাসনকে বললাম। একদিন তাকে শুকনো  কুমার নদের মধ্য দিয়ে পাঁচুড়িয়া বাজারে নিয়ে গেলাম। কলেজের প্রতি অকৃত্রিম সহযোগিতার  হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য তাকে সংবর্ধনা দিলাম। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অনেক লোক সমাগম হলো। কাজী সাহাবউদ্দিন (সাহেব কাজী) , আবু সালেহসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনে খুবই উৎসাহী ছিলেন।

শহীদুল হাসান অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে যদুনন্দী কালীনগর ব্রিজ দেখে বললো, ‘স্যার, এত কাছাকাছি দুটো ব্রিজ দেয়া যাবে না। তাছাড়া নদীতে পানিও থাকে না’। আমি বললাম, ‘ও  সব বুঝি না ব্যবস্থা কর’। ছাত্র-ছাত্রী ও জনগণের যাতায়াত সুবিধার জন্য ব্রিজ দিতে হবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে বললো, ‘দেখা যাক স্যার কী করা যায়’। কিছুদিন পরে ফরিদপুর এল.জি.ই.ডি থেকে আমাকে জানানো হলো যে, যদুনন্দী পাঁচুড়িয়া ব্রিজ এবং বড়খারদিয়া ড. আঃ মান্নানের বাড়ির কাছের ব্রিজের স্থান নির্ধারণের জন্য লোক যাবে। পরিদর্শন টিন আসবে ঢাকা থেকে। যথাসময়ে পরিদর্শন টিম এলো। পাঁচুড়িয়া হাটে গাড়ি রেখে পরিদর্শন টিম মাপজোফের কাজ শেষ করলেন। আমাদের বাড়িতে পরিদর্শন টিমকে সকালের নাস্তা করালাম। তখন শীতকাল। অন্য আয়োজনের সাথে ভাবী ‘দুধ চিতই’ পিঠা তৈরি করে রেখেছিলেন। শহরবাসীর কাছে ‘দুধ-চিতই পিঠা খুবই আনন্দের খাবার। যা হোক, চা-পান শেষে পরিদর্শন টিম খারদিয়ায় গেলো। সেখানকার কাজ শেষ করে দুপুরে ড. আঃ মান্নানের বাড়িতে তাদের আপ্যায়ন করা হলো। কিছুদিন পরেই যদুনন্দী পাঁচুড়িয়ার ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সমাপ্তও হলো সময়মত। চার উপজেলার যোগাযোগ নিরাপদ ‘নো খেয়া –নো সাঁকো’ হয়ে গেল। সবই মহান আল্লাহ গফুরুর রাহিমের ইচ্ছা। ওছিলা প্রকৌশলী শহীদুল হাসান।

কলেজ  প্রতিষ্ঠায় জমি-অর্থ-শ্রম-সম্পদ-বুদ্ধি দিয়ে যারা সাহায্য করেছেন, তাঁদের সবার নাম আমার এ-লেখায় থাকুক আর নাই থাকুক তাতে কিছু এসে যায় না। যাদের নাম উল্লেখ করতে পেরেছি তারা বড়, আর যাঁদের নাম উল্লেখ করতে ভুল হলো তারা ছোট- এমনটি নয়। কুড়িয়ে পাওয়া সেই চার আনা থেকে শুরু করে যারা লাখ টাকা দিয়েছেন-সকলেই কলেজের গর্বিত দাতা। আমি সকলের কাছে ঋণী।

এ-লেখায় কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, যদি কোন ভুল –ভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেটার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি আপনাদেরই লোক, আপনাদের জন্যই আজীবন কাজ করেছি। সকলের ভাল করতে গিয়ে আমার হাতে কারো কোন ক্ষতি হয়ে থাকলে নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিবেন। আপনাদের এলাকার প্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আপনারা সুন্দরভাবে পরিচালনা করবেন। সভ্য মানুষ সৃষ্টিতে সাহায্য করবেন। আপনাদের কাছে দোয়া চাই। শেষ করতে চাই এই বলে-

“ছোট ছো্ট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল,

গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।

মুহূর্ত নিমেষ কাল তুচ্ছ পরিমাণ-

গড়ে যুগ-যুগান্তর অনন্ত মহান”।

পুনশ্চঃ কলেজে সম্মান শ্রেণি খোলা হলো ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। কলেজের কর্মচারী শাজাহান এবং প্রাক্তন ছাত্র নাজিম (বর্তমানে অত্র কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক) কয়েক বছর যাবৎ অসম্ভব রকমের বিরক্ত করছিলো আমাকে কলেজে সম্মান শ্রেণি খোলার জন্য। অপেক্ষা করছিলাম শিক্ষক মন্ডলীর মধ্যে থেকে কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় কিনা। সম্মান শ্রেণির খোলার জন্য কেউ আগ্রহ দেখায়নি বরং তাঁদের মন্তব্য ছিলো ‘এটা একটা বাড়তি ঝামেলা’। যা হোক  সম্মান শ্রেণি খোলার প্রস্তুতি নিলাম। নাজিম ও শাহজাহান প্রচার কাজ করেছে।

অক্রান্ত শ্রম দিয়েছে চতুর্থ শ্রেণির সকল কর্মচারী। আমি এক পর্যায়ে চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লাম। হার্ট অপারেশন হলো। কলেজ সৃষ্টির সময় যে কষ্ট করেছি তার চেয়ে বেশী কষ্ট হলো। এমতাবস্থায় নাজিম কলেজ পরিদর্শককে জানালেন ‘অনার্স খোলা না হলে স্যারকে (প্রফেসর মিঞা লুৎফার রহমান) আবার অপারেশন করা লাগবে’। শেষ পর্যন্ত  সকল বাঁধা পেরিয়ে  সব নিয়ম-কানুন যথাযথ পূরণ করে সম্মান শ্রেণি খোলা হলো প্রত্যাশিত তিনটি বিষয়ে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও সমাজকর্ম। সম্মান খোলার ব্যাপারে ঋণী হলাম মাননীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. কাজী মোঃ শহিদুল্লাহ, কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, উপ-রেজিষ্ট্রার কাজী নাসিরউদ্দীন এবং সহকারী কলেজ পরিদর্শক সেলিম হোসেন মোল্লার কাছে। এ ব্যাপারে আরো ঋণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ.আই.এস বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. সফিক আহমেদ সিদ্দীক, প্রফেসর ড. স্বপন কুমার বালা, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল হাকিম সরকার (বর্তমান ভিসি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া), এম.আই.এস. বিভাগের প্রফেসর আলী আক্কাস ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক এস.এম মুজাহিদুল ইসলাম এর কাছে। নবকাম পল্লী কলেজের নাম এখন নবকাম পল্লী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ লেখাটা যদিও ভুল কিন্তু এটা চলিত ভুল হিসাবে গৃহীত। নবকাম পল্লী কলেজ সৃষ্টি এবং প্রতি ধাপে এর উন্নয়নের জন্য যাঁরা সাহায্য করেছেন তাঁদের সকলের মঙ্গল কামনা করি।

 

Nabokam Polli University College
Post Office: Jadunandi, Upazila: Shaltha, District: Faridpur
Phone: 01712-614704, 01712-367647

Copyright © 2024. reserved by নবকাম পল্লী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ. Design & Developed by DINBODOL.COM

S5 Box